সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দী অপরাধীদের আলোর পথ দেখাতে নেয়া হয়েছে ব্যতিক্রমী নানা উদ্যোগ। বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে কয়েদিরা। তাদের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি ও একতারা বিক্রি হচ্ছে বাজারে। কারা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপে বদলে গেছে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের চিত্র।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, দুই বছর আগে আত্মকর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে এবং স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্য নিয়ে বন্দীদের জন্য কুষ্টিয়া কারাগারের ভেতরে চালু করা হয় বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ কোর্স। প্রথম দিকে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও এখন সুবিধা পাচ্ছেন কয়েদি ও হাজতিরা।
নতুন কোনো আসামি কারাগারে আসলে তার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কেউ লেখাপড়া ও নাম স্বাক্ষর না জানলে তাকে আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হয়। কারাগারে আসার পরদিনই শুরু হয় নাম স্বাক্ষর শেখানো। বর্তমানে একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত সোহেল রানা এখন এখানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
সোহেল রানা বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত কারাগারে আসার পর থেকে প্রায় ৯০০ জনকে স্বাক্ষরসহ লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৩ হাজার ২৮৮ জনকে স্বাক্ষরসহ লেখাপড়া শেখানো হয়েছে।
লাহিনীপাড়া এলাকার পারুল নামের এক নারী বলেন, তার স্বামী ইসমাইল কারাগারে আছেন। নাম স্বাক্ষরসহ লেখাপড়া জানতেন না। কারাগারে আসার পর এখন পড়তে পারেন নামও লিখতে পারেন। এছাড়া কুরআন শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন তিনি।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কারগারকে প্রকৃত পক্ষেই সংশোধনাগার করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, চোরসহ নানা অপরাধ করে আসা আসামিরা কারাগার থেকে বের হয়ে যাতে কাজ করে তাদের জীবন বদলাতে পারে, নিজেদের আত্মশুদ্ধি করতে পারে সেজন্য তাঁতপল্লী ও হস্ত শিল্প, পাওয়ার লুম, দর্জি প্রশিক্ষণ, পুঁথির কাজ, ইলেকট্রিক এন্ড হাউজ ওয়ারিং এর মত বিষয়গুলোতে হাজতিদের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকদিরাও শিখছে এসব কাজ।
কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকার মুনসাদ আলীর ছেলে নুর মোহাম্মদ। একটি মামলায় তিনি বেশ কিছুদিন কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দী ছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় নুর মোহাম্মদ তিন মাস মেয়াদী ইলেকট্রিক এন্ড হাউজ ওয়ারিং হিসেবে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। জামিনে বের হয়ে এসে তিনি এখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রতিদিন তার গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা উপার্জন হয়। যা দিয়ে ভালোভাবেই তার সংসার চলে।
তার মতো নাহিদ হাসান, নাসিম, চান্নু মিয়া, সুমন আহমেদ, রুবেল হোসেন, ফজলে রাব্বিসহ অনেকেই এখন পেশাদার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। কারাগার তাদের আলোর পথ দেখিয়েছি। অপরাধ ছেড়ে বেছে নিয়ে পেশা। এতে তাদের মর্যাদা বেড়েছে সমাজের কাছে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে কয়েকজন শিক্ষক এসে প্রথমে কয়েদিদের প্রশিক্ষণ দেন। এরপর কয়েদিরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে নিজেরায় হস্ত শিল্প ও পাওয়ার লুমে কাজ করছেন। তারা নিজেরাই শাড়ি, লুঙ্গি উৎপাদন করেছেন কারাগারে। এসব পণ্য কুষ্টিয়া কারাগারের সামনে কারা পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্রে রাখা হয় বিক্রির জন্য। পণ্য বিক্রির অর্ধেক দেয়া হয় কয়েদিদের হাতে। এছাড়া কয়েদিদের হাতে বানানো একতারা লালন একাডেমির অনুষ্ঠানে অতিথিদের দেয়া হয়। প্রতিদিন সকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও কারাগার থেকে পৃথকভাবে কুরআন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে বন্দীদের।
ভাদালিয়া এলাকায় বাড়ি রুবেল হুসাইন জানান, কারাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাইরের একটি দোকানে চাকরি শুরু করেছেন। প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। ভাদালিয়া বাজারে মা টেলিকমে কাজ করেন রুবেল।
একই সাথে বিনোদনের জন্য জেল সুপার জাকের হোসেন সাংস্কৃতিক টিম গঠন করেছেন। কয়েদিদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠন করেছেন তিনি। নিয়মিত সঙ্গীত প্রশিক্ষণসহ পরিবেশন করেন শিল্পীরা। জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কারাগার পরিদর্শনে গেলে এ দলের সদস্যরা গান পরিবেশন করেন। একই সাথে কারা অভ্যন্তরে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। বন্দীদের বই পড়ার সুযোগ দিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে অর্থের অভাবে লাইব্রেরির অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
এ বিষয়ে জেল সুপার জাকের হোসেন বলেন, বন্দীদের আলোর পথে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নাম স্বাক্ষরসহ লেখাপড়া শেখা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি পাওয়ার লুম, দর্শি, হস্তচালিত তাঁত, ইলেকট্রিক, সঙ্গীত চর্চার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্দীদের মাঝে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীসহ অন্য আসামিদের আলোর পথে আনতে এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।